
রান্নার তেলে লুকানো ক্যানসারের সম্ভাবনা: লিনোলেইক অ্যাসিড ও স্তন ক্যানসারের অজানা যোগসূত্র
লাবণী একজন গৃহিণী। সংসারের সকল দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়েই তিনি গড়ে তুলেছিলেন এক শান্তির নীড়। তিন বেলা রান্না, স্বামী-সন্তানের পছন্দমতো খাবার—সবকিছুতেই ছিল তার যত্ন। রান্নায় ব্যবহার করতেন বাজারে প্রচলিত সয়াবিন তেল। স্বাস্থ্য নিয়ে খুব একটা ভাবতেন না, কারণ সচরাচর অসুস্থ হতেন না।
কিন্তু একদিন হঠাৎ করেই তিনি অনুভব করলেন বাম স্তনে একটি শক্ত গাঁঠ। ডাক্তার দেখানোর পর ধরা পড়ল ‘ট্রিপল নেগেটিভ ব্রেস্ট ক্যানসার’। চিকিৎসা শুরু হলো, কিন্তু তার মনে প্রশ্ন উঁকি দিতে লাগলো—”এটা কেন হলো? আমি তো কখনো ধূমপান করিনি, ঠিকঠাক খেতাম, শরীরচর্চা না করলেও মোটামুটি সচেতনই ছিলাম।“
সেই প্রশ্নের উত্তর কিছুটা মিলতে শুরু করেছে সাম্প্রতিক গবেষণায়, যেখানে রান্নার তেলে থাকা এক উপাদানকে দায়ী করা হয়েছে এই ধরণের ক্যানসারের জন্য।
লিনোলেইক অ্যাসিড: প্রতিদিনের খাবারে থাকা এক অজানা উপাদান
লিনোলেইক অ্যাসিড এক ধরনের ওমেগা-৬ ফ্যাটি অ্যাসিড, যা সাধারণত সয়াবিন, সূর্যমুখী ও কর্ন অয়েল—এই তেলগুলোতে প্রচুর পরিমাণে থাকে। এটি একদিকে আমাদের শরীরের জন্য প্রয়োজনীয়, কারণ শরীর নিজে থেকে এটি তৈরি করতে পারে না, কিন্তু অপরদিকে এর অতিরিক্ত গ্রহণ শরীরের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
গবেষণায় কী পাওয়া গেছে?
নিউ ইয়র্কের ওয়েইল কর্নেল মেডিসিনের গবেষকরা দেখতে পান, লিনোলেইক অ্যাসিড স্তন ক্যানসারের একটি নির্দিষ্ট ধরন—ট্রিপল নেগেটিভ ব্রেস্ট ক্যানসারের কোষে থাকা একটি প্রোটিন FABP5 এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে একটি নির্দিষ্ট কোষীয় পথ (mTORC1 pathway) সক্রিয় করে।
এই mTORC1 পথ কোষের বৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি অস্বাভাবিকভাবে সক্রিয় হলে টিউমার দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এই গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব মাউসকে উচ্চমাত্রায় লিনোলেইক অ্যাসিডযুক্ত খাদ্য খাওয়ানো হয়েছে, তাদের টিউমার তুলনামূলকভাবে বড় হয়েছে।
মানুষের শরীরেও মিল পাওয়া গেছে
ট্রিপল নেগেটিভ ব্রেস্ট ক্যানসারে আক্রান্ত মানুষের রক্তে FABP5 ও লিনোলেইক অ্যাসিডের মাত্রা বেশি পাওয়া গেছে। এর মানে দাঁড়ায়, শুধু প্রাণী নয়, মানুষের শরীরেও এই উপাদানটি সম্ভবত ক্যানসার বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে।
গবেষণার মূল লেখক ড. জন ব্লেনিস বলেন,
“এই আবিষ্কার আমাদের খাদ্যচর্চা এবং ক্যানসারের সম্পর্ক নিয়ে আরও গভীরভাবে চিন্তা করার সুযোগ করে দিচ্ছে।”
শুধু স্তন ক্যানসার নয়, আরও অনেক কিছু
এই প্রভাব শুধু স্তন ক্যানসারে সীমাবদ্ধ নয়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রোস্টেট ক্যানসারসহ আরও কিছু টিউমারেও এর সম্ভাব্য প্রভাব রয়েছে। তাই এই উপাদানটির প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এখন থেকেই ভাবা জরুরি।
তাহলে কি রান্নার তেল একেবারেই খাওয়া যাবে না?
এখানেই সতর্কতা দরকার। গবেষণা বলছে না যে রান্নার তেল একেবারে ত্যাগ করতে হবে। বরং এখানে গুরুত্বপূর্ণ হলো “পরিমাণ” এবং “বৈচিত্র্য“। সব তেলেই এক রকম উপাদান থাকে না। উদাহরণস্বরূপ, অলিভ অয়েলে লিনোলেইক অ্যাসিডের পরিমাণ অনেক কম এবং এতে মনোস্যাচুরেটেড ফ্যাট বেশি থাকে, যা উচ্চ তাপে রান্নার জন্য বেশি উপযোগী।
ওমেগা-৬ বনাম ওমেগা-৩: ভারসাম্যের খেলা
আমাদের আধুনিক খাদ্যাভ্যাসে ওমেগা-৬ এর পরিমাণ অনেক বেশি, বিশেষ করে প্রসেসড ফুড ও বাজারের তেলে। কিন্তু ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের অভাব রয়েছে, যা পাওয়া যায় মাছ, আখরোট ও ফ্ল্যাক্সসিডে।
এই ভারসাম্যহীনতাই দীর্ঘমেয়াদে শরীরে ক্রনিক ইনফ্ল্যামেশন সৃষ্টি করতে পারে, যা ক্যানসারসহ বহু রোগের জন্ম দিতে পারে।
গবেষণায় দ্বিমতও আছে
গবেষণা একমুখী নয়। ২০২৩ সালে ১৪টি গবেষণার ওপর ভিত্তি করে করা এক মেটা-অ্যানালাইসিসে দেখা যায়, সাধারণ জনগণের মধ্যে লিনোলেইক অ্যাসিড খাওয়া এবং স্তন ক্যানসারের মধ্যে কোনো সরাসরি সম্পর্ক নেই।
এর মানে গবেষণার বিষয়বস্তু ও লক্ষ্যগোষ্ঠী অনুযায়ী ফলাফল ভিন্ন হতে পারে। যেমন—FABP5 মাত্রা বেশি থাকা রোগীদের ক্ষেত্রে লিনোলেইক অ্যাসিডের প্রভাব বেশি হতে পারে।
মিডিয়ার শিরোনামে বিভ্রান্ত না হয়ে বুঝে শুনে সিদ্ধান্ত নিন
আমরা যখন ক্যানসার নিয়ে কিছু পড়ি বা শুনি, তখন স্বাভাবিকভাবেই আতঙ্ক তৈরি হয়। কিন্তু প্রতিটি গবেষণার একটি নির্দিষ্ট পরিপ্রেক্ষিত থাকে। রান্নার তেল একমাত্র দায়ী নয়; জেনেটিক্স, লাইফস্টাইল, পরিবেশ—সবকিছুই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
এই গবেষণাটি আমাদের খাদ্যাভ্যাস নিয়ে চিন্তা করার একটা নতুন জানালা খুলে দিয়েছে, তবে তা আতঙ্ক নয়, বরং সচেতনতার সুযোগ করে দিয়েছে।
সুস্থ খাদ্যাভ্যাসই প্রধান অস্ত্র
হার্ভার্ডের এক দীর্ঘমেয়াদি গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব মানুষ ফল, শাকসবজি, বাদাম, পূর্ণ শস্য ও লো-ফ্যাট ডেইরি জাতীয় খাবার নিয়মিত খেতেন, তারা তুলনামূলকভাবে দীর্ঘজীবী ও স্বাস্থ্যবান ছিলেন।
ওজনই ক্যানসারের প্রধান রিস্ক ফ্যাক্টর
ওয়ার্ল্ড ক্যান্সার রিসার্চ ফান্ডের মতে, রান্নার তেল একা দোষী নয়, বরং অতিরিক্ত ওজন ও স্থূলতাই ক্যানসারের প্রধান খাদ্যজনিত কারণ। তাই ক্যালোরি ব্যালেন্স, শারীরিক কার্যকলাপ এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসই মূল দাওয়াই।
রান্নার তেলে নয়, দায়ী আমরা নিজেরাই?
রান্নার তেল আমাদের জীবনের অংশ, কিন্তু সেটিকে কীভাবে, কতটুকু এবং কোন ধরনের তেল ব্যবহার করছি, সেটাই আসল বিষয়। একক কোনো উপাদান বা খাবারকে ‘ভিলেন’ বানিয়ে লাভ নেই। বরং সামগ্রিক খাদ্য ও জীবনচর্চার পরিবর্তনই পারে ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে।
তাই লাবণীর মতো যেন আমাদের গল্প না হয়, সেজন্য আজ থেকেই ভাবতে হবে—প্লেটের প্রতিটি উপাদান নিয়ে।
লেখাটি ভালো লেগে থাকলে আমাকে ফেসবুকে অনুসরণ করতে পারেন। এছাড়াও আমি টুইটারে এবং ইন্সটাগ্রামে সক্রিয় আছি।
মন্তব্য করুন