
মৃত্যুর পর শরীরের আলো নিভে যায়: একটি চমকপ্রদ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার
বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যা। ঢাকার একটি ছোট্ট হাসপাতালের আইসিইউ কেবিনে নিঃশব্দে শুয়ে ছিলেন বৃদ্ধা মনোয়ারা বেগম। ৭২ বছরের জীবনে অনেক যুদ্ধ করেছেন—ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ—সবকিছুর সঙ্গে লড়েছেন সিংহীর মতো। তার পাশে বসে ছিল একমাত্র ছেলে রায়হান। নিঃশব্দে মায়ের হাত ধরে রেখেছিল সে। তখন হঠাৎ করেই তার মনে এক অদ্ভুত অনুভূতি হলো—মায়ের দেহটা যেন হঠাৎ নিস্তেজ হয়ে গেল, শুধু নিস্তেজ নয়, যেন কোথাও একটা আলো নিভে গেল।
রায়হান কখনোই অতিপ্রাকৃত ব্যাপারে বিশ্বাস করত না। কিন্তু সেদিন তার মনে হয়েছিল, যেন মায়ের শরীরের ভেতরের কোনো অদৃশ্য আলো থেমে গেছে। কয়েক ঘণ্টা পর, যখন সে বাড়ি ফিরল, ইউটিউবে একটি ভিডিও তার চোখে পড়ল—”We Emit a Visible Light That Vanishes When We Die – Says Surprising New Study.” কৌতূহলবশত ক্লিক করল সে, আর যা জানল, তা যেন তার সেই অদ্ভুত অনুভূতিকে বৈজ্ঞানিক স্বীকৃতি দিয়ে দিল।
এখান থেকেই শুরু হয় আজকের লেখার মূল আলোচনা—একটি আশ্চর্য বৈজ্ঞানিক গবেষণার পেছনের গল্প, যেখানে দেখা গেছে, মানুষসহ সব জীবজন্তু এবং উদ্ভিদের দেহ থেকে একধরনের সূক্ষ্ম আলো বিচ্ছুরিত হয়, এবং মৃত্যুর পর সেই আলো নিভে যায়।
জীবন্ত প্রাণীর শরীর থেকে আলো বিচ্ছুরণ—গুজব না সত্য?
“জীবন আলোকিত” – এই বাক্যটি বরাবরই একরকম রূপক বা কাব্যিক ভাবনার মতো শোনায়। কিন্তু গবেষকরা বলছেন, বিষয়টি কেবল রূপক নয়, বাস্তবও বটে।
কানাডার University of Calgary ও National Research Council of Canada যৌথভাবে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, জীবন্ত কোষ থেকে সত্যিই একধরনের অতিসূক্ষ্ম আলো বের হয়, যাকে বলে Ultraweak Photon Emission (UPE)। এই আলো আমাদের খালি চোখে দেখা সম্ভব নয়, তবে অত্যন্ত সংবেদনশীল ক্যামেরার মাধ্যমে তা ধরা যায়।
এই গবেষণার সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় হলো—এই আলো মৃত্যুর পরে সম্পূর্ণভাবে থেমে যায়।
তাহলে কি আমরা মৃত্যুর আগে পর্যন্ত “জ্বলছি”?
গবেষক ড. ভাহিদ সালারি এবং তার দল বলছেন, হ্যাঁ—সব জীবন্ত প্রাণীর দেহই নিরবচ্ছিন্নভাবে অতিসূক্ষ্ম আলো (বা বায়োফোটন) নিঃসরণ করে। এবং যখন প্রাণ চলে যায়, এই আলোও নিভে যায়। ঠিক যেন একটি প্রদীপের শিখা বাতাসে নিভে যাওয়ার মতো।
গবেষণার বিস্ময়কর পরীক্ষা: ইঁদুর এবং উদ্ভিদের ওপর আলো বিচ্ছুরণ
এই গবেষণায় গবেষক দল চারটি ইঁদুরকে অন্ধকার কক্ষে রেখে প্রথমে জীবিত অবস্থায় তাদের শরীর থেকে নির্গত আলো পরিমাপ করেন, তারপর তাদের নিস্তেজ করে সেই একই মাপজোক করেন। প্রতিটি ইঁদুরকে মৃত্যুর পরেও দেহের তাপমাত্রা ঠিক রাখা হয় যেন তাপের পরিবর্তন আলোর মাত্রাকে প্রভাবিত না করে।
ফলাফল ছিল পরিষ্কার—জীবিত অবস্থায় প্রতিটি ইঁদুরের শরীর থেকে অনবরত অতিসূক্ষ্ম আলো নির্গত হচ্ছিল। কিন্তু মৃত্যুর পর সেই আলো একেবারেই কমে যায়, প্রায় নিঃশেষ হয়ে যায়।
একই রকম পরীক্ষা করা হয় Arabidopsis thaliana (এক প্রকার তালের মতো উদ্ভিদ) এবং Heptapleurum arboricola (ছায়াগাছ) গাছের পাতায়।
গবেষকরা পাতায় আঘাত বা রাসায়নিক চাপ প্রয়োগ করে দেখেছেন, চাপপ্রাপ্ত অংশগুলো অন্য অংশের চেয়ে বেশি আলো নির্গত করছে।
এই আলো কোথা থেকে আসে?
এই আলো আসার মূল কারণ হলো আমাদের দেহকোষের Reactive Oxygen Species (ROS)—যেমন হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড ইত্যাদি। যখন কোষগুলো চাপের মধ্যে পড়ে—উচ্চ তাপমাত্রা, বিষাক্ত উপাদান বা পুষ্টির অভাবের কারণে—তখন এরা রসায়নিক প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে ফোটন বা আলো কণিকা নির্গত করে।
এই ঘটনাকে Chemiluminescence বলা হয়, যা আগুন বা বিদ্যুৎ ছাড়াই আলো তৈরি করে।
মৃত্যু মানেই আলোর নিভে যাওয়া: বিজ্ঞান বলছে তাই
গবেষণাটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করেছে—আমরা কি জীবিত থাকা অবস্থায় সারাক্ষণ একধরনের আলো বিকিরণ করি? এবং সেই আলো কি স্বাস্থ্য, স্ট্রেস বা রোগের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত?
গবেষকরা বলছেন, এই আলো যদি নির্ভরযোগ্যভাবে মাপা যায়, তাহলে ভবিষ্যতে এটি নন-ইনভেসিভ মেডিকেল ডায়াগনস্টিক টুল হতে পারে। মানে রক্ত বা স্ক্যান ছাড়াই শুধু শরীর থেকে নির্গত আলো দিয়ে জানা যাবে, আপনি অসুস্থ কি না।
মৃত্যুর আগমুহূর্তে শরীরের আলো নিভে যাওয়ার তাৎপর্য
আমরা জানি, মৃত্যুর সময় দেহের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কাজ বন্ধ করে দেয়। কিন্তু এই গবেষণা দেখিয়েছে, এমনকি কোষীয় পর্যায়েও মৃত্যুর একটি “আলো নিভে যাওয়া” প্রতীক রয়েছে।
এটা একদিকে বৈজ্ঞানিক বিস্ময়, অন্যদিকে দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক আলোচনারও ভিত্তি হতে পারে। হাজার বছর ধরে নানা সংস্কৃতি বলেছে, মানুষের দেহে একটি “আত্মার আলো” আছে। এখন বিজ্ঞান হয়তো সেই আলোকে ব্যাখ্যা করছে কোষের বায়োফোটন হিসেবে।
আরও কী জানা দরকার?
এই গবেষণা এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে। মানুষের শরীরের আলো বা বায়োফোটন এখনো পুরোদমে চিহ্নিত হয়নি, কারণ তা পরিবেশের আলো, তাপ ও অন্যান্য বিকিরণের নিচে চাপা পড়ে যায়। তবে এই গবেষণা প্রমাণ করেছে যে এটি কোনো কল্পনা নয়—এটি বাস্তব এবং মাপযোগ্য।
শেষ কথা
রায়হানের গল্পের মতো, হয়তো একদিন আমরা সত্যিই জানতে পারব—কোন আলো আমাদের ভেতরে জ্বলছে, আর কখন সেই আলো নিভে যাচ্ছে। হয়তো চিকিৎসা, কৃষি, পরিবেশ এমনকি জীবনের মানেও বড় একটা পরিবর্তন আসবে এই একফোঁটা আলো থেকে।
এই আলো যেন জীবন আর মৃত্যুর মাঝখানে একটি সূক্ষ্ম রেখা। আমরা হয়তো এই আলো ধরেই বুঝতে পারব, কার জীবন জ্বলছে পূর্ণতায়, আর কে নিভে যাচ্ছে নিঃশব্দে।
লেখাটি ভালো লেগে থাকলে আমাকে ফেসবুকে অনুসরণ করতে পারেন। এছাড়াও আমি টুইটারে এবং ইন্সটাগ্রামে সক্রিয় আছি।
মন্তব্য করুন