
জীবনের আগেই বার্ধক্য: স্কিজোফ্রেনিয়া রোগীদের মস্তিষ্কে সময়ের ছাপ
সুব্রত ছিল মাত্র ২৪ বছর বয়সী এক তরুণ। ঢাকার এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো, বন্ধুদের মাঝে খুব প্রাণচঞ্চল আর হাসিখুশি ছিলো। কিন্তু হঠাৎ করেই তার আচরণে পরিবর্তন দেখা গেল। সে বলতো, কিছু অদৃশ্য মানুষ তাকে অনুসরণ করছে। কখনো কারো কণ্ঠস্বর শুনতো, যা আসলে বাস্তবে ছিল না। প্রথমে পরিবার ভেবেছিল স্ট্রেস, হয়তো পড়াশোনার চাপ। কিন্তু ধীরে ধীরে সুব্রত একা হয়ে যেতে লাগলো, কষ্ট পেত, সন্দেহ করতো সবার ওপর, নিজের মনের সাথে লড়াই করছিল প্রতিনিয়ত।
ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার পর ধরা পড়ল—স্কিজোফ্রেনিয়া। কিন্তু আরও চমকে ওঠার মতো বিষয় ছিলো MRI রিপোর্টে। সুব্রতের মস্তিষ্কে যে পরিবর্তন এসেছে, তা একজন ৫০ বছর বয়সী মানুষের মস্তিষ্কের মতো!
এই গল্পটা শুধু সুব্রতের না। বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ তরুণ-তরুণী, যারা এই রোগে আক্রান্ত, তাদের অনেকেরই মস্তিষ্ক সময়ের আগেই বার্ধক্যে পৌঁছে যায়। আজকের এই লেখায় আমরা জানবো কেন এমন হয়, কীভাবে এই রোগ মস্তিষ্কে সময়ের ছাপ ফেলে, আর গবেষণা কী বলছে এই বিষয়ে।
স্কিজোফ্রেনিয়া: এক রহস্যময় মানসিক রোগ
স্কিজোফ্রেনিয়া এমন এক মানসিক রোগ, যেটা মানুষের চিন্তা, উপলব্ধি, আবেগ এবং আচরণকে প্রভাবিত করে। এটি একটি ক্রনিক এবং গুরুতর মানসিক অসুস্থতা, যার লক্ষণ হিসেবে থাকতে পারে—ভ্রম (delusion), মিথ্যা বিশ্বাস, হ্যালুসিনেশন (কিছু দেখা বা শোনা যা বাস্তবে নেই), বিশৃঙ্খল চিন্তা, এবং বাস্তবতা বিচ্ছিন্নতা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতে, বিশ্বব্যাপী প্রায় ২ কোটিরও বেশি মানুষ স্কিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত। সাধারণত কিশোর বয়সের পর থেকে বা তরুণ বয়সে এর লক্ষণ প্রকাশ পেতে শুরু করে।
এই রোগের সবচেয়ে ভয়ানক দিক হলো—এটা একজন মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে সম্পূর্ণরূপে বদলে দিতে পারে। পড়াশোনা, সম্পর্ক, কর্মজীবন—সবকিছুতে বিশাল প্রভাব ফেলে। রোগী নিজেই বুঝতে পারে না সে কীভাবে বদলে যাচ্ছে।
কীভাবে স্কিজোফ্রেনিয়া শুরু হয়?
স্কিজোফ্রেনিয়ার সঠিক কারণ এখনও নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি, তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এটি নিউরোডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডার, অর্থাৎ মস্তিষ্কের বিকাশজনিত জটিলতা থেকেই এ রোগের সূচনা হয়।
এই রোগের সঙ্গে অটিজম, ডিসলেক্সিয়া, ADHD-এর মতো অন্যান্য নিউরোডেভেলপমেন্টাল রোগগুলোর কিছু মিল রয়েছে। তবে পার্থক্য হলো—অন্য রোগগুলো সাধারণত শৈশবে প্রকাশ পায়, কিন্তু স্কিজোফ্রেনিয়া সাধারণত শুরু হয় ১৮ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে।
এই সময়টাই একজন মানুষের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়—ক্যারিয়ার গড়ার, আত্মপরিচয় তৈরির সময়। আর এই সময়েই যদি রোগের ছোবল পড়ে, তাহলে তার জীবন পুরোপুরি ভেঙে পড়তে পারে।
গবেষণায় দেখা গেছে, জেনেটিক (বংশগত) কারণ, পরিবেশ, স্ট্রেস, এমনকি গর্ভাবস্থার সময়ে মায়ের কোনো ইনফেকশন বা পুষ্টিহীনতাও শিশুর ভবিষ্যৎ স্কিজোফ্রেনিয়া ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
নতুন গবেষণার চমকপ্রদ তথ্য
সম্প্রতি এক দল গবেষক এমন এক তথ্য দিয়েছেন, যা স্কিজোফ্রেনিয়ার রহস্য আরো এক ধাপ উন্মোচন করেছে।
তারা বলছেন—স্কিজোফ্রেনিয়ার পেছনে মস্তিষ্কের দ্রুত বার্ধক্যপ্রাপ্তি-ও একটি বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
গবেষণায় দেখা গেছে, স্কিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের রক্তে এক ধরনের প্রোটিন পাওয়া যায়—যার নাম Neurofilament Light protein (NfL)। এই প্রোটিন সাধারণত তখনই রক্তে প্রবেশ করে, যখন নিউরন (মস্তিষ্কের কোষ) নষ্ট বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
অর্থাৎ, NfL-এর পরিমাণ বাড়া মানেই মস্তিষ্কের কোষের ক্ষতি বাড়ছে। স্কিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তদের রক্তে এই NfL প্রোটিনের পরিমাণ স্বাভাবিক মানুষের তুলনায় অনেক বেশি। আর এই প্রবণতা বয়সের সাথে দ্রুত বাড়ে।
এটা ইঙ্গিত করে যে, স্কিজোফ্রেনিয়া শুধু একধরনের মানসিক সমস্যা না, বরং মস্তিষ্কের বায়োলজিক্যাল বার্ধক্যকেও ত্বরান্বিত করে।
NfL প্রোটিন কীভাবে কাজ করে?
NfL বা নিউরোফিলামেন্ট লাইট প্রোটিন হলো একধরনের স্ট্রাকচারাল প্রোটিন যা নিউরনের গঠন ধরে রাখতে সাহায্য করে। যখন কোনো কারণে নিউরন ক্ষতিগ্রস্ত হয় (যেমন ট্রমা, নিউরোডিজেনারেটিভ ডিজিজ, বা স্কিজোফ্রেনিয়া), তখন এই প্রোটিন ভেঙে রক্তে বা স্পাইনাল ফ্লুইডে প্রবেশ করে।
NfL-এর মাত্রা বাড়া মানেই নিউরন ক্ষতির ইঙ্গিত।
এই কারণে NfL এখন বিভিন্ন মস্তিষ্কজনিত রোগ শনাক্ত করতে বায়োমার্কার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
NfL এর উচ্চ মাত্রা পাওয়া গেছে:
- আলঝেইমারস ডিজিজে
- পার্কিনসনস ডিজিজে
- মাল্টিপল স্ক্লেরোসিসে
- ডিমেনশিয়ায়
গবেষণায় দেখা গেছে, স্কিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের NfL লেভেল অস্বাভাবিকভাবে বয়সের তুলনায় অনেক বেশি, যা বোঝায় যে তাদের মস্তিষ্ক সময়ের আগেই বার্ধক্যে পৌঁছে যাচ্ছে।
মস্তিষ্কের বার্ধক্য: সাধারণ বনাম স্কিজোফ্রেনিয়া
স্বাভাবিকভাবে মানুষের বয়স বাড়ার সাথে সাথে মস্তিষ্কে কিছু পরিবর্তন আসে। যেমন:
- গ্রে ম্যাটার কমে
- হোয়াইট ম্যাটারের সংযোগ দুর্বল হয়
- মেমোরি, রিয়্যাকশন টাইম, মাল্টিটাস্কিং একটু কমে যায়
কিন্তু স্কিজোফ্রেনিয়ায় এই পরিবর্তনগুলো অনেক বেশি দ্রুত ও ভয়াবহ হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, স্কিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তদের মস্তিষ্কে এই প্রক্রিয়াগুলো এমনভাবে ঘটে, যেন তাদের মস্তিষ্কের বয়স বাস্তব বয়সের চেয়ে ২০-২৫ বছর বেশি।
এর মানে, একজন ২৫ বছরের তরুণের মস্তিষ্ক যদি স্কিজোফ্রেনিয়া আক্রান্ত হয়, তাহলে সেটার কাঠামো ও কার্যকারিতা হতে পারে একজন ৪৫-৫০ বছর বয়সী মানুষের মতো!
স্কিজোফ্রেনিয়ার মস্তিষ্ক কেন দ্রুত বার্ধক্যপ্রাপ্ত হয়?
স্কিজোফ্রেনিয়ায় মস্তিষ্ক কেন এত দ্রুত বুড়িয়ে যায়, তার কারণগুলো বেশ জটিল। গবেষণায় কয়েকটি বিষয় সামনে এসেছে:
১. নিউরনের মৃত্যু: স্কিজোফ্রেনিয়ায় নিউরনের সেল-ডেথ দ্রুত হয়। ফলে মস্তিষ্কের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হতে থাকে।
২. অক্সিডেটিভ স্ট্রেস: কোষে অতিরিক্ত ফ্রি র্যাডিক্যাল জমে নিউরন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
৩. নিউরোইনফ্লামেশন: মস্তিষ্কে দীর্ঘমেয়াদি ইনফ্লামেশনও কোষ ক্ষয়ের কারণ হতে পারে।
৪. জেনেটিক ও এনভায়রনমেন্টাল ইন্টারঅ্যাকশন: স্কিজোফ্রেনিয়া আক্রান্তদের জেনেটিক গঠনের সাথে পরিবেশগত প্রভাব মিলে বার্ধক্য ত্বরান্বিত করে।
জীবনধারার প্রভাব
একটি বিশাল সত্য হলো—স্কিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত মানুষেরা সাধারণত এমন একধরনের জীবনযাপন করেন, যা তাদের স্বাস্থ্য আরও খারাপ করে তোলে। যেমন:
- দীর্ঘ সময় ধরে বেকারত্ব বা আইসোলেশন
- শারীরিক অনুশীলনের অভাব
- ধূমপান ও মাদক সেবনের প্রবণতা
- খারাপ খাদ্যাভ্যাস
এই কারণগুলো শুধু মস্তিষ্ক নয়, পুরো শরীরের বার্ধক্যও দ্রুত ঘটায়।
কিছু উদ্বেগজনক পরিসংখ্যান:
- স্কিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তদের গড় আয়ু সাধারণ মানুষের চেয়ে ২০-৩০ বছর কম।
- প্রায় ৫০% রোগীর অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক রোগ থাকে (মুটিয়ে যাওয়া, হৃদরোগ, ব্যথাজনিত সমস্যা)।
- ড্রাগ অ্যাডিকশনের ঝুঁকিও অনেক বেশি।
আরেকটা বড় সমস্যা হলো—অনেক সময় রোগীরা চিকিৎসা ঠিকভাবে মেনে চলেন না। যার ফলে সমস্যা আরও গভীর হয়।
গবেষণা কী বলছে?
এই নতুন গবেষণাগুলো আমাদেরকে একটি বিষয় স্পষ্ট করে বলছে—স্কিজোফ্রেনিয়া শুধু একটি মানসিক রোগ না, বরং এটা একটি জৈবিকভাবে বার্ধক্যপ্রবণ অসুস্থতা, যা সময়ের আগেই মস্তিষ্কে অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন নিয়ে আসে।
NfL প্রোটিনের মতো বায়োমার্কার এখন চিকিৎসকদের জন্য এক নতুন দিশা তৈরি করছে। ভবিষ্যতে হয়তো এই ধরনের টেস্টের মাধ্যমে আমরা আগেভাগেই রোগ শনাক্ত করতে পারবো, এবং চিকিৎসা আরও কার্যকর করতে পারবো।
স্কিজোফ্রেনিয়া নিয়ে সমাজে যতটা ভয়, অবজ্ঞা বা ভুল ধারণা আছে, তার থেকে বেরিয়ে এসে এখন সময় বিজ্ঞানসম্মত আলোচনার।
কারণ, কোনো একজন সুব্রতের জন্যই না—এটা আমাদের সমাজের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ।
যত দ্রুত আমরা বুঝতে শিখব, তত দ্রুত আমরা বদল আনতে পারব।
লেখাটি ভালো লেগে থাকলে আমাকে ফেসবুকে অনুসরণ করতে পারেন। এছাড়াও আমি টুইটারে এবং ইন্সটাগ্রামে সক্রিয় আছি।
মন্তব্য করুন