
পৃথিবীর মৃত্যু: ভয়াবহ বিপদ সংকেত ও মানবজাতির ভূমিকা
পৃথিবীর মৃত্যু, এটি কী বাস্তবে সম্ভব?
হ্যাঁ, এটি সম্ভব।
শুধু পৃথিবীর মৃত্যু নয়, পৃথিবীর সাথে সাথে সমাপ্তি ঘটবে সমস্ত জীবের। ধ্বংস হয়ে যাবে এই সুন্দর পৃথিবীর সব বৈচিত্র্য। পাহাড়-পর্বত, সাগর-মহাসাগর, সবুজ বনাঞ্চল, বায়ুমণ্ডলসহ পৃথিবীর সবকিছু ধ্বংস হয়ে একাকার হয়ে যাবে। আর পৃথিবীর এই মৃত্যুর জন্য দায়ী থাকবো আমরা, মানবজাতি।
পৃথিবীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
বিজ্ঞানীরা কার্বন-১৪ ডেটিংয়ের মাধ্যমে বস্তু বা প্রত্নবস্তুর বয়স নির্ধারণ করেন। তবে পৃথিবীর শুরুর দিকের কোন পাথর টিকে না থাকায় সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয় কখন পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছিল।
ধারণা করা হয়, সৌরজগৎ সৃষ্টির প্রায় ১০০ মিলিয়ন বছর পর সংঘর্ষের মাধ্যমে পৃথিবীর সৃষ্টি হয়। আজ থেকে প্রায় ৪.৪৫ বিলিয়ন বছর আগে পৃথিবী গঠন হয়, সৃষ্টি হয় লৌহকেন্দ্র ও বায়ুমণ্ডল।
পৃথিবী গঠনের পর ‘থিয়া’ নামের একটি মঙ্গল আকৃতির গ্রহাণুর সাথে সংঘর্ষের ফলে থিয়া ধ্বংস হয়ে যায় এবং এর ধ্বংসাবশেষ থেকে চাঁদ সৃষ্টি হয়।
থিয়ার সাথে সংঘর্ষে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। তৈরি হয় জ্বলন্ত আগুনের মহাসাগর, যা ধীরে ধীরে ঠাণ্ডা হয়ে লাভা জমাট বেঁধে পাথরে পরিণত হয়। তৈরি হয় প্রথম প্রাচীনতম খনিজ ‘জিরকন’।
কালের বিবর্তনে প্রাণের আবির্ভাব ঘটে। তবে উল্কাপিণ্ডের আঘাতে বিবর্তন প্রক্রিয়া বিঘ্নিত হয় এবং ডাইনোসর যুগের সমাপ্তি ঘটে।
এরপর আসে পাঁচটি দীর্ঘ বরফযুগ। সময়ের পরিবর্তনের সাথে প্রাণের পুনরায় আবির্ভাব ঘটে এবং মানবজাতি ও আধুনিক পৃথিবী গড়ে ওঠে।
বর্তমান পৃথিবীর অবস্থার বিশ্লেষণ
আমরা এখনো একটি বরফযুগের মধ্যে বাস করছি। প্রায় ১১,৫০০ বছর আগে শুরু হওয়া এই বরফযুগ এখন ধীরে ধীরে শেষের দিকে, আর পৃথিবীর তাপমাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ উষ্ণায়ন বিভিন্ন কারণে ঘটছে, যার প্রধান কারণ হল মানবজাতির কর্মকাণ্ড।
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাব
বৈশ্বিক উষ্ণায়ন হল এক দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া, যেখানে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
শিল্পবিপ্লবের পর থেকে মানবজাতির ক্রমবর্ধমান কার্যকলাপ যেমন ফসিল জ্বালানি পোড়ানো, যানবাহনের ব্যবহার বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন কলকারখানার নির্গত ধোঁয়া ইত্যাদি কারণে বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে।
এই গ্রিনহাউস গ্যাসগুলি তাপকে আটকে রেখে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়িয়ে তুলছে।
বায়ুদূষণের প্রভাব
মানবজাতির বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কারণে বায়ুদূষণও ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কলকারখানার বর্জ্য, যানবাহনের ধোঁয়া, বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে নির্গত গ্যাস ইত্যাদি কারণে বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড এবং অন্যান্য ক্ষতিকর গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এসব গ্যাস শুধু বায়ুদূষণই নয়, স্বাস্থ্যগত সমস্যা সৃষ্টি করতেও ভূমিকা রাখছে।
বন উজাড়ের প্রভাব
বনভূমি উজাড় হওয়ার ফলে জীববৈচিত্র্যের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।
বনাঞ্চল ধ্বংস হওয়ার কারণে অনেক প্রাণীর আবাসস্থল বিলুপ্ত হচ্ছে, ফলে অনেক প্রজাতি বিলুপ্তির পথে। বনভূমি ধ্বংস হওয়ার কারণে কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণের হার কমে যাচ্ছে, যা গ্রিনহাউস প্রভাবকে আরও তীব্র করে তুলছে।
ভূমি দূষণের প্রভাব
শিল্পবর্জ্য, প্লাস্টিক এবং অন্যান্য রাসায়নিক বর্জ্য মাটিতে মিশে মাটি দূষিত করছে। এর ফলে কৃষিজমি অনুপযোগী হয়ে পড়ছে এবং খাদ্যশৃঙ্খলে বিষাক্ত পদার্থ প্রবেশ করছে, যা মানব স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অস্বাভাবিক আবহাওয়ার ঘটনাগুলি বেড়ে গেছে।
দীর্ঘমেয়াদী খরা, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, অতিরিক্ত বন্যা, এবং ঘূর্ণিঝড়ের পরিমাণ ও তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ মানুষের জীবন ও সম্পদের ওপর ভয়ানক প্রভাব ফেলছে।
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির প্রভাব
এন্টার্টিকা এবং অন্যান্য পর্বতের বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে, ফলে উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলো পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। হিমালয়ের বরফ গলে যাওয়ার ফলে উত্তরাঞ্চলে ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।
প্রায়ই মারাত্মক প্রাকৃতিক বিপর্যয় সংঘটিত হচ্ছে। ভেবে দেখুন, এভাবে চলতে থাকলে পৃথিবীর অবস্থার কী পরিবর্তন হবে?
ধীরে ধীরে আমাদের এই সবুজ পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে।
তাপীয় সাম্যবস্থার প্রভাব
পৃথিবীর মৃত্যু ঘটবে যখন এনট্রপি বা পরিবর্তনের মান শূন্য হবে। তাপমাত্রার পরিবর্তনের কারণে এনথালপির পরিবর্তন ঘটে, যার ফলে কাজ সংঘটিত হয়।
কিন্তু তাপমাত্রার পরিবর্তন না হলে কি হবে?
তাপমাত্রার পরিবর্তন না হলে এনট্রপি বা পরিবর্তনের মান শূন্য হবে, যার ফলে কোন কাজ সংঘটিত হবে না। এই অবস্থাকে বলা হয় তাপীয় সাম্যবস্থা।
যেমন, পানি পূর্ণ একটি বালতির সাথে একটি খালি বালতির সংযোগ করলে যতক্ষণ পানির আদান প্রদান চলবে ততক্ষণ কাজ সংঘটিত হবে। যখন পানি সাম্যবস্থায় আসবে অর্থাৎ দুপাশের পানি আর যাওয়া আসা করবে না তখন আর কোন কাজ সংঘটিত হবে না।
তেমনি বায়ুমণ্ডলে তাপের পরিবর্তন ঘটছে বলেই পৃথিবীর ক্রিয়া হচ্ছে। পৃথিবীর ঘূর্ণনসহ সমস্ত ক্রিয়াকলাপ সংঘটিত হচ্ছে। কিন্তু যখন তাপমাত্রা বাড়তে বাড়তে সাম্যবস্থায় পৌঁছাবে, অর্থাৎ তাপের আর কোন পরিবর্তন হবে না তখন বন্ধ হয়ে যাবে পৃথিবীর সমস্ত ক্রিয়াকলাপ।
ধ্বংস হয়ে যাবে এই পৃথিবী, একাকার হয়ে যাবে পৃথিবীর সমস্ত কিছু। আর এভাবেই ঘটবে পৃথিবীর মৃত্যু। যার জন্য আমরা মানবজাতি নিজেরাই দায়ী।
অচিরেই আমরা এই সবুজ পৃথিবীকে বর্জ্যে ভরা দূষিত গ্রহে পরিণত করতে চলেছি।
মানবজাতির দায়িত্ব
যে মানবজাতি এই আধুনিক পৃথিবী গড়ে তুলেছে, সেই মানবজাতিই পুনরায় পৃথিবীকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
আমাদের অত্যধিক ভোগবিলাস, প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহার, এবং পরিবেশের প্রতি উদাসীনতার ফলে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের বর্তমান কর্মকাণ্ড যদি অপরিবর্তিত থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে পৃথিবীকে রক্ষা করা আমাদের জন্য অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়বে।
পরিবেশের প্রতি আমাদের দায়িত্বশীল আচরণই পারে এই বিপর্যয় থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করতে। তাই আমাদের এখনই সচেতন হতে হবে এবং যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমরা একটি বাসযোগ্য পৃথিবী রেখে যেতে পারি।
লেখাটি ভালো লেগে থাকলে আমাকে ফেসবুকে অনুসরণ করতে পারেন। এছাড়াও আমি টুইটারে এবং ইন্সটাগ্রামে সক্রিয় আছি।
মন্তব্য ( 6 )
সুন্দর লিখেছেন।
অসাধারণ।
কীভাবে আমরা আমাদের পরিবেশের জন্য কিছু করতে পারি যাতে আগামী প্রজন্মের মানুষেরা একটি সুন্দর ও সুস্থ পৃথিবীতে বাস করতে পারে?
আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মানুষদের জন্য পরিবেশ রক্ষায় বেশ কিছু উপায় অনুসরণ করতে পারি। পাবলিক পরিবহন বা সাইকেল ব্যবহার করে আমাদের কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমানো, বাড়ি ও পরিবেশ সংরক্ষণে বিদ্যুৎ ও পানি সংরক্ষণ করা এবং আমাদের সমাজে টেকসই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা উচিত বলে আমি মনে করি। এই ধরনের সহজ পদক্ষেপ আগামী প্রজন্মের জন্য আমাদের পৃথিবী সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
এই পরিস্থিতির কী কোনো সমাধান আছে?
আসলে এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। তবে প্রযুক্তির উন্নত ব্যবহার, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, গ্রীন ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রণালী, ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট, ওয়েস্ট রিসাইক্লিং ইত্যাদি পরিবেশে সহায়তা করতে পারে।