
চেরনোবিল: ইতিহাসের সেই ভয়াল দিনের স্মৃতিচারণ
১৯৮৬ সালের ২৬ এপ্রিল, চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের রিয়েক্টর-৪ এ ঘটে যায় পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ পারমাণবিক দুর্ঘটনা।
সেদিন রিয়েক্টর-৪ এ এক বিপর্যয়কর বিস্ফোরণ ঘটে, যা থেকে নির্গত তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ ছিল হিরোশিমায় ফেলা বোমার প্রায় ৫০০ গুণ বেশি।
কিন্তু কি ঘটেছিল সেদিন কন্ট্রোল রুমে? এটি নিছকই দুর্ঘটনা ছিল নাকি কারো অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার ফলাফল?
পারমাণবিক বিদ্যুতের সূচনা
পারমাণবিক বিদ্যুতের শুরু হয়েছিল ১৯৪৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসি অঙ্গরাজ্যে। ওকে ব্রিজের এক্স-১০ গ্রাফাইট চুল্লী ছিল প্রথম পারমাণবিক কেন্দ্র, যেখানে প্রথমবারের মতো পারমাণবিক শক্তি দ্বারা বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়।
১৯৫৪ সালের ২৭ জুন তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের অবনিনিস্ক শহরে বিশ্বের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পাওয়ার গ্রিডের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়।
চেরনোবিল দুর্ঘটনার দিন
চেরনোবিল দুর্ঘটনার দিন, ২৬ এপ্রিল ১৯৮৬, রিয়েক্টর-৪ এর কর্মীরা একটি সেফটি টেস্ট পরিচালনা করছিল। এই টেস্টটি করার কথা ছিল ডে শিফটে, কিন্তু শেষ মুহূর্তে পাওয়ার গ্রিডের অনুরোধে তা নাইট শিফটে পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
নাইট শিফটের কর্মীরা এই টেস্ট সম্পর্কে পূর্বে অবহিত ছিলেন না। সঠিক নির্দেশনার অভাবে তারা টেস্টটি সঠিকভাবে পরিচালনা করতে ব্যর্থ হন।
RBMK রিয়েক্টরের গঠন এবং ত্রুটি
চেরনোবিলের রিয়েক্টরগুলো ছিল RBMK টাইপ নিউক্লিয়ার রিয়েক্টর। এসব রিয়েক্টরে কন্ট্রোল রড হিসেবে ব্যবহৃত হয় বোরন রড, যা গ্রাফাইট দিয়ে ঢাকা থাকে। চুল্লিতে ইউরেনিয়াম-২৩৫ ফুয়েল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
ইউরেনিয়াম-২৩৫ এর ফাটনের ফলে তৈরি হয় জেনন নামক একটি মৌল, যা রিয়েক্টরের ভেতরে বিষাক্ত অবস্থার সৃষ্টি করে। অর্ধেক উৎপাদন ক্ষমতায় চলার কারণে রিয়েক্টরের ভেতরে জেননের পরিমাণ বেড়ে যায়, যা নিয়ন্ত্রণ করা হয় কন্ট্রোল রড দিয়ে।
চেরনোবিলের দুর্ঘটনার কারণ
রাতে সেফটি টেস্ট পরিচালনার সময় কর্মীরা একের পর এক কন্ট্রোল রড সরিয়ে নিতে থাকে। রিয়েক্টর-৪ এ মোট ২১১ টি কন্ট্রোল রড ছিল, যার মধ্যে ২০৬ টি কন্ট্রোল রডই তারা উঠিয়ে নেয়।
এরপর তারা রিয়েক্টর বন্ধ করার জরুরি বাটন চাপলে গ্রাফাইট কন্ট্রোল রড সবার আগে প্রবেশ করে, যা রিয়েক্টরের রিয়েক্টিভিটি বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। এতে করে রিয়েক্টরের ভেতরে তেজস্ক্রিয়তার বিক্রিয়া দ্রুত বেড়ে যায়, এবং চুল্লিটি হয়ে উঠে অনিয়ন্ত্রিত।
চেরনোবিলের দুর্ঘটনার ফলাফল
রিয়েক্টরের উপরের ১০০০ টন ওজনের কংক্রিটের ঢাকনা একটি বিস্ফোরণের মাধ্যমে উড়ে যায় এবং রিয়েক্টর-৪ হয়ে পড়ে উন্মুক্ত ও অরক্ষিত। বিকিরণের হার দাঁড়ায় ৩৩,০০০ রন্টজেন প্রতি ঘণ্টা, যেখানে স্বাভাবিক বিকিরণের হার থাকে ৪-৬ রন্টজেন প্রতি ঘণ্টা। দুর্ঘটনার ফলে সরাসরি প্রাণ হারায় ৩১ জন এবং পরবর্তীতে থাইরয়েড ক্যান্সারে মৃত্যু হয় আরও প্রায় ৩০০ জনের।
সোভিয়েত সরকারের ভূমিকা
দুর্ঘটনার জন্য সোভিয়েত সরকারও অনেকাংশে দায়ী ছিল। ১৯৭৫ সালে কুর্চাটোভ ইন্সটিটিউট অফ নিউক্লিয়ার সায়েন্সের এক গবেষক “RBMK” টাইপ রিয়েক্টরের শীতলীকরণ দুর্বলতা সম্পর্কে একটি গবেষণা পত্র প্রকাশ করেন, যা সোভিয়েত সরকার কখনো প্রকাশ করেনি। তাদের অবহেলা ও উদাসীনতার কারণে এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়।
চেরনোবিলের বর্তমান অবস্থা
আজও চেরনোবিলের ২৬০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জনসাধারণের প্রবেশাধিকার নেই। এই দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমানে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও কঠোর করা হয়েছে।
চেরনোবিল দুর্ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয় পারমাণবিক শক্তির ব্যবহারে সতর্কতা ও দায়িত্বশীলতার প্রয়োজনীয়তা। এই ভয়াবহ ঘটনার মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি যে, প্রযুক্তির উন্নতির পাশাপাশি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি ও দায়িত্বশীলতার গুরুত্ব অপরিসীম।
লেখাটি ভালো লেগে থাকলে আমাকে ফেসবুকে অনুসরণ করতে পারেন। এছাড়াও আমি টুইটারে এবং ইন্সটাগ্রামে সক্রিয় আছি।
মন্তব্য করুন