মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ ও স্নায়ুরোগ: অ্যালঝাইমারের ঝুঁকি নিয়ে গবেষণা
আমাদের আধুনিক জীবনযাত্রা প্লাস্টিক ছাড়া প্রায় অকল্পনীয়। কিন্তু এই আশীর্বাদই এখন পরিণত হয়েছে এক নীরব অভিশাপে।
আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা প্লাস্টিকের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা, যা মাইক্রোপ্লাস্টিক নামে পরিচিত, নিঃশব্দে আমাদের শরীরে প্রবেশ করছে। নতুন এক গবেষণা এই উদ্বেগ আরও বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।
রোড আইল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক ইঁদুরের উপর চালানো এক যুগান্তকারী গবেষণায় দেখতে পেয়েছেন, যদি আপনার শরীরে আলঝেইমার রোগের জন্য দায়ী জিনগত ঝুঁকি আগে থেকেই থেকে থাকে, তবে মাইক্রোপ্লাস্টিক গ্রহণ আপনার মস্তিষ্কের জন্য মারাত্মক সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে। এটি আপনার জ্ঞানীয় দক্ষতাকে দ্রুত ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিতে পারে।
এই গবেষণাটি মূলত দুটি বিষয়ের মধ্যে এক ভয়ঙ্কর সংযোগ স্থাপন করেছে: একটি হলো আমাদের জন্মগত জিনগত গঠন, এবং অন্যটি হলো আমাদের পরিবেশ, যা আজ প্লাস্টিক দ্বারা দূষিত।
চলুন, এই চাঞ্চল্যকর গবেষণার গভীরে প্রবেশ করা যাক এবং জেনে নেওয়া যাক, এই অদৃশ্য শত্রু আমাদের মস্তিষ্কের জন্য কতটা বিপজ্জনক হয়ে উঠছে।

গবেষণার প্রেক্ষাপট: জিন এবং পরিবেশের সম্মিলিত প্রভাব
আলঝেইমার একটি মস্তিষ্কের রোগ যা সময়ের সাথে সাথে স্মৃতিশক্তি এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ মানসিক কার্যকারিতা নষ্ট করে দেয়। বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরেই জানেন যে, কিছু জিনগত বৈশিষ্ট্য এই রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
এর মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত হলো APOE4 (Apolipoprotein E4) জিন ভ্যারিয়েন্ট। যাদের শরীরে এই জিনটি থাকে, তাদের আলঝেইমার হওয়ার সম্ভাবনা অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি।
কিন্তু বিজ্ঞানীরা এটাও লক্ষ্য করেছেন যে, শুধুমাত্র জিন থাকাই রোগ হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। এমন অনেক মানুষ আছেন যাদের শরীরে APOE4 জিন থাকা সত্ত্বেও তারা আলঝেইমার রোগে আক্রান্ত হন না। এখানেই পরিবেশগত প্রভাবকগুলোর ভূমিকা সামনে আসে। গবেষকরা জানতে আগ্রহী ছিলেন যে, পরিবেশের কোন বিষাক্ত উপাদানগুলো এই জিনগত ঝুঁকিকে জাগিয়ে তুলতে পারে।
নিউরোসায়েন্টিস্ট জেইম রসের ভাষায়, “আলঝেইমারের সাথে সম্পর্কিত এমন অনেক পরিবর্তনযোগ্য ফ্যাক্টর রয়েছে যা আমরা অধ্যয়ন করছি – যেমন খাদ্যাভ্যাস, ব্যায়াম, ভিটামিন এবং বিশেষ করে পরিবেশগত বিষাক্ত পদার্থ যেমন মাইক্রোপ্লাস্টিক।”
তার প্রশ্নটি ছিল খুবই সরল কিন্তু শক্তিশালী: “যদি আপনার শরীরে APOE4 জিন থাকে এবং আপনি প্রচুর পরিমাণে মাইক্রোপ্লাস্টিক গ্রহণ করেন, তবে এটি কি আলঝেইমার রোগকে ত্বরান্বিত করবে?”
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই এই গবেষণাটি ডিজাইন করা হয়।
ইঁদুরের উপর চালানো যুগান্তকারী পরীক্ষা

এই বিষয়টি পরীক্ষা করার জন্য, গবেষকরা ইঁদুরকে দুটি প্রধান দলে ভাগ করেন।
- প্রথম দল: এই ইঁদুরগুলোর শরীরে আলঝেইমারের ঝুঁকি বাড়ায় এমন APOE4 জিন ভ্যারিয়েন্ট ছিল।
- দ্বিতীয় দল: এই ইঁদুরগুলোর শরীরে APOE3 জিন ভ্যারিয়েন্ট ছিল, যা আলঝেইমারের ঝুঁকিকে প্রভাবিত করে না। এদেরকে কন্ট্রোল গ্রুপ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
এরপর প্রতিটি দলের ইঁদুরকে আবার দুটি উপ-দলে ভাগ করা হয়। কিছু ইঁদুরকে সাধারণ পানীয় জল দেওয়া হয়, এবং বাকিদের পানীয় জলের সাথে মাইক্রোপ্লাস্টিক মিশিয়ে দেওয়া হয়। মোট চারটি গ্রুপ নিয়ে এই পরীক্ষাটি চালানো হয়:
- APOE4 জিন + মাইক্রোপ্লাস্টিকযুক্ত জল
- APOE4 জিন + সাধারণ জল
- APOE3 জিন + মাইক্রোপ্লাস্টিকযুক্ত জল
- APOE3 জিন + সাধারণ জল
এই পরীক্ষার মাধ্যমে গবেষকরা দেখতে চেয়েছিলেন, শুধুমাত্র মাইক্রোপ্লাস্টিক, নাকি শুধুমাত্র জিন, নাকি উভয়ের সংমিশ্রণ মস্তিষ্কের কার্যকারিতায় পরিবর্তন আনে।
ফলাফল: জ্ঞানীয় দক্ষতায় উদ্বেগজনক পরিবর্তন
ফলাফল ছিল আশ্চর্যজনক এবং অত্যন্ত উদ্বেগজনক। জ্ঞানীয় দক্ষতা পরিমাপের জন্য ডিজাইন করা বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে গবেষকরা দেখতে পান যে, শুধুমাত্র সেই ইঁদুরগুলোর আচরণে পরিবর্তন এসেছে যাদের শরীরে APOE4 জিন ছিল এবং যারা মাইক্রোপ্লাস্টিকযুক্ত জল পান করেছিল।
অন্যান্য গ্রুপের ইঁদুররা—অর্থাৎ, যাদের APOE3 জিন ছিল (মাইক্রোপ্লাস্টিক গ্রহণকারী ও গ্রহণ না করা উভয়ই) এবং যাদের APOE4 জিন থাকা সত্ত্বেও মাইক্রোপ্লাস্টিকের সংস্পর্শে আসেনি—তারা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক আচরণ করেছে।
এই ফলাফল স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, জিনগত ঝুঁকি এবং মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি—এই দুটির সম্মিলিত প্রভাবই ইঁদুরগুলোর মধ্যে জ্ঞানীয় অবক্ষয়ের লক্ষণ তৈরি করেছে। বিষয়টি অনেকটা এমন যে, APOE4 জিনটি একটি সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো, আর মাইক্রোপ্লাস্টিক সেই আগ্নেয়গিরিতে অগ্নিসংযোগ করেছে।
লিঙ্গভেদে ভিন্ন লক্ষণ: মানুষের রোগের সাথে অদ্ভুত মিল
গবেষণার সবচেয়ে চমকপ্রদ দিকগুলোর মধ্যে একটি ছিল আক্রান্ত ইঁদুরদের মধ্যে লিঙ্গভেদে লক্ষণের ভিন্নতা।
- পুরুষ ইঁদুর: যে পুরুষ APOE4 ইঁদুরদের মাইক্রোপ্লাস্টিক দেওয়া হয়েছিল, তাদের মধ্যে উদাসীনতার (Apathy) মতো আচরণ দেখা যায়। তারা তাদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে এবং নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে।
- নারী ইঁদুর: অন্যদিকে, নারী APOE4 ইঁদুরদের মধ্যে স্মৃতিশক্তি হ্রাসের (Memory Impairment) লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তারা নতুন জিনিস মনে রাখতে পারছিল না।
আশ্চর্যজনকভাবে, এই প্যাটার্নটি মানুষের আলঝেইমার রোগীদের মধ্যেও দেখা যায়। আলঝেইমারে আক্রান্ত পুরুষদের মধ্যে প্রায়শই উদাসীনতা এবং আচরণগত পরিবর্তন প্রথমে প্রকাশ পায়, যেখানে নারীদের ক্ষেত্রে স্মৃতিশক্তি হ্রাস পাওয়ার সমস্যাটিই প্রধান লক্ষণ হিসেবে দেখা দেয়। ইঁদুরের মধ্যে এমন মিল খুঁজে পাওয়াটা মাইক্রোপ্লাস্টিকের সাথে আলঝেইমারের সংযোগকে আরও জোরালো করে তুলেছে।
জেইম রস বলেন, “যখন আপনি মানুষের মধ্যে আলঝেইমার রোগের জন্য পরিচিত সবচেয়ে বড় ঝুঁকির কারণ বহনকারী প্রাণীগুলোকে মাইক্রো এবং ন্যানোপ্লাস্টিকের সংস্পর্শে আনেন, তখন তাদের আচরণে লিঙ্গ-নির্ভর পরিবর্তন দেখা যায়, যা আলঝেইমার রোগীদের মধ্যে আমরা যে লিঙ্গ-নির্ভর পার্থক্য দেখি তার অনুরূপ।”

মস্তিষ্কের গভীরে: প্রদাহ এবং আলঝেইমারের প্রাথমিক লক্ষণ
গবেষকরা আরও দেখেছেন যে, মাইক্রোপ্লাস্টিক গ্রহণকারী APOE4 ইঁদুরদের মস্তিষ্কে প্রদাহের (inflammation) কিছু লক্ষণ দেখা গেছে, যা সাধারণত আলঝেইমার রোগের সাথে সম্পর্কিত। যদিও ইঁদুরগুলো পুরোপুরি আলঝেইমার রোগে আক্রান্ত হয়নি, তবে তাদের মস্তিষ্কে এমন কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে যা এই রোগের প্রাথমিক ধাপ হিসেবে বিবেচিত হয়।
এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পর্যবেক্ষণ। কারণ আলঝেইমারের ক্ষেত্রে প্রায়শই এটি নির্ধারণ করা কঠিন হয় যে, মস্তিষ্কের কোন পরিবর্তনগুলো রোগের কারণে ঘটছে এবং কোনগুলো রোগটিকে চালিত করছে। এই গবেষণায় অল্প সময়ের মধ্যে আলঝেইমারের মতো পরিবর্তন দেখা যাওয়াটা ইঙ্গিত দেয় যে, মাইক্রোপ্লাস্টিক হয়তো রোগের প্রক্রিয়াকে শুরু বা ত্বরান্বিত করতে পারে।
জিনই কি একমাত্র নিয়তি? পরিবেশগত ঝুঁকির ভূমিকা
কারও শরীরে একটি APOE4 জিন থাকা মানেই যে তার আলঝেইমার হবে, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। এটি কেবল ঝুঁকি বাড়ায়। বহু মানুষ এই জিন নিয়েও সুস্থ জীবনযাপন করেন। এটিই প্রমাণ করে যে, এই রোগের পেছনে জিন ছাড়াও অন্যান্য ফ্যাক্টর জড়িত। বিজ্ঞানীরা সেই ফ্যাক্টরগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন।
এই গবেষণার ফলাফলের উপর ভিত্তি করে, এখন মনে হচ্ছে যে প্লাস্টিক দূষণ সেই অতিরিক্ত ফ্যাক্টরগুলোর মধ্যে একটি হতে পারে। আমরা জানি যে মাইক্রোপ্লাস্টিক রক্তপ্রবাহের মাধ্যমে মস্তিষ্কে পৌঁছাতে পারে, কিন্তু এই এক্সপোজার ঠিক কতটা ক্ষতিকারক, তা এখনো পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। এই গবেষণা সেই অজানা অধ্যায়ের উপর নতুন করে আলোকপাত করলো।
গবেষণার তাৎপর্য এবং ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা
যদিও এই গবেষণাটি শুধুমাত্র ইঁদুরের উপর করা হয়েছে, এর তাৎপর্য বিশাল। এটি প্রথমবারের মতো প্রমাণ করেছে যে, একটি সাধারণ পরিবেশগত দূষক (মাইক্রোপ্লাস্টিক) একটি নির্দিষ্ট জিনগত ঝুঁকির সাথে মিলিত হয়ে মস্তিষ্কের রোগের মতো উপসর্গ তৈরি করতে পারে।
জেইম রস যেমনটা বলেছেন, “এটা খুবই আকর্ষণীয় যে আমরা ইঁদুরের মধ্যে যা দেখছি, তা বাস্তব জগতে মানুষের মধ্যে যা দেখা যায় তার সাথে মিলে যাচ্ছে।”
এই গবেষণাটি একটি সতর্কবার্তা। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্লাস্টিকের ব্যবহার এবং এর ফলে সৃষ্ট দূষণ নিয়ে আমাদের আরও অনেক বেশি সচেতন হতে হবে। এই অদৃশ্য শত্রু হয়তো আমাদের ধারণার চেয়েও অনেক বড় ক্ষতি করছে।
রস আরও যোগ করেন, “আমরা মাইক্রো এবং ন্যানোপ্লাস্টিকের এই ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে আরও গবেষণাকে উৎসাহিত করতে চাই।”
এখন প্রয়োজন মানুষের উপর এর প্রভাব নিয়ে আরও গভীর এবং বিস্তৃত গবেষণা, যাতে আমরা এই নীরব ঘাতকের হাত থেকে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করতে পারি।
লেখাটি ভালো লেগে থাকলে আমাকে ফেসবুকে অনুসরণ করতে পারেন। এছাড়াও আমি টুইটারে এবং ইন্সটাগ্রামে সক্রিয় আছি।
মন্তব্য করুন