
অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ে (আদ্যোপান্ত)
অনলাইনে যারা কেনাকাটা করেন, তারা নিশ্চয়ই অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ে সম্পর্কে কিছুটা জানেন।
রকমারি, দারাজ বা পিকাবুতে শপিং করার পর, যারা প্রিপেমেন্ট পদ্ধতি বেছে নেন, তারা বিকাশ, রকেট, শিওরক্যাশ, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড বা ইন্টারনেট ব্যাংকিং ব্যবহার করে বিল পরিশোধ করেন।
যে সুরক্ষিত ওয়েবপেজে আপনাকে বিল প্রদানের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়, সেটিই অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ে।
অনেকেই হয়তো ভেবেছেন, এই পেমেন্ট গেটওয়ে কীভাবে কাজ করে। তাদের জন্যই আজকের এই লেখা। আসুন শুরু করা যাক।
অনলাইনে বিল পরিশোধ এখন আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে গেছে। শুধু ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ডই নয়, আমরা বিভিন্ন মোবাইল ওয়ালেট ও নেটব্যাংকিং মাধ্যমেও লেনদেন করছি। করোনা ভাইরাসের কারণে বিশ্বব্যাপী ব্যবসায় কার্যক্রম অনলাইনে চলে আসার পর, ডিজিটাল লেনদেন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। তাই ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো পেমেন্ট গেটওয়ের সাথে যুক্ত হয়ে দ্রুত পেমেন্ট গ্রহণ করছে।
অনলাইনে পেমেন্ট করা খুবই সহজ এবং সাবলীল। এর মাধ্যমে আপনি পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে যেকোনো পণ্য বা সেবা সহজেই ক্রয় করতে পারেন। আপনি যদি একজন বিক্রেতা হন, তাহলে বিশ্বের যেকোনো স্থানে আপনার পণ্য বিক্রি করতে পারেন, শুধুমাত্র ইন্টারনেট কানেকশন থাকা একটি স্মার্টফোনের মাধ্যমেই।
তাহলে, অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ে কী? এর মাধ্যমে লেনদেন করা কি নিরাপদ? আপনার ব্যবসাকে অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ের সাথে যুক্ত করা কি লাভজনক? চলুন এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে দেখি।
অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ে কী?
অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ে (Payment Gateway or PG) একটি টানেলের মতো কাজ করে, যা আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা অর্থের উৎসের সাথে যেখানে আপনি অর্থ স্থানান্তর করতে চান তার নিরাপদ সংযোগ স্থাপন করে।
পিজি একটি সফটওয়্যার, যা আপনাকে বিভিন্ন পেমেন্ট মোড, যেমন নেট ব্যাংকিং, ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ড, মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সিস্টেমের মাধ্যমে লেনদেন করার সুযোগ দেয়। এটি একটি তৃতীয় পক্ষের সিস্টেম, যা নিরাপদে আপনার অর্থ উৎস থেকে মার্চেন্ট পেমেন্ট পোর্টালে স্থানান্তর করে।
ধরুন আপনি রকমারি ডট কম থেকে একটি বই কিনতে চান। বইয়ের মূল্য পরিশোধ করতে আপনাকে সাহায্য করবে অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ে।
অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ে কীভাবে কাজ করে?
অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ের প্রধান উদ্দেশ্য হলো তথ্যের নিরাপদ স্থানান্তর নিশ্চিত করা। ট্রানজেকশন সম্পন্ন করতে যেসব তথ্য প্রয়োজন, তা অত্যন্ত গোপনীয় এবং নিরাপত্তার খাতিরে এনক্রিপশনের মাধ্যমে সুরক্ষিত থাকে। এতে করে মাঝপথে কেউ তথ্যগুলো পড়তে বা বুঝতে পারে না।
অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ে কাজ করার ধাপসমূহ
অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ে বেশ কিছু ধাপে কাজ সম্পাদন করে। নিচে ধাপসমূহ উল্লেখ করা হলো।
ধাপ ১: প্রথমে একজন ক্রেতা তার কেনাকাটার তালিকা তৈরি করে এবং অর্ডার প্লেস করে চেক-আউট বাটনে ক্লিক করেন।
ধাপ ২: এরপর ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ক্রেতাকে একটি পেমেন্ট গেটওয়েতে নিয়ে যায়, যেখানে ক্রেতা তার ব্যাংক বা কার্ডের তথ্য প্রদান করেন। পেমেন্ট গেটওয়ে ক্রেতাকে ব্যাংক পোর্টাল বা একটি ৩-ডি সিকিউরড পেইজে নিয়ে যায় ট্রানজেকশন অনুমোদনের জন্য।
ধাপ ৩: পেমেন্ট গেটওয়ে ট্রানজেকশনের অনুমোদন পাওয়ার পর ব্যাংক ক্রেতার তথ্যগুলো যাচাই করে এবং তার অ্যাকাউন্টে পর্যাপ্ত ব্যালেন্স আছে কিনা চেক করে ট্রানজেকশন করা যাবে কিনা তা সিদ্ধান্ত নেয়।
ধাপ ৪: ব্যাংকের অনুমোদন পেলে মার্চেন্ট ক্রেতাকে একটি মেসেজ পাঠায়। যদি ব্যাংক অনুমোদন না দেয়, তাহলে একটি এরর মেসেজ পাঠানো হয়, যেখানে কেন ট্রানজেকশন ব্যর্থ হয়েছে তার কারণ উল্লেখ থাকে।
ধাপ ৫: মার্চেন্টের অনুরোধে ব্যাংক চাহিত অর্থ মার্চেন্ট পোর্টালে স্থানান্তর করে।
উপরোক্ত ধাপগুলো সঠিকভাবে সম্পন্ন হলে ই-কমার্স পোর্টাল ক্রেতাকে একটি কনফার্মেশন মেসেজ পাঠায়, যাতে অর্ডার গৃহীত হওয়ার তথ্য থাকে।
এভাবে, অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ে নিরাপদ ও সহজে লেনদেন সম্পন্ন করার জন্য কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
অনলাইন ট্রাঞ্জেকশনে ব্যবহৃত ব্যাংক বা কার্ডের তথ্য অত্যন্ত গোপনীয়, তাই এই তথ্যগুলিকে সুরক্ষিত রাখা অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়েগুলোর প্রধান অগ্রাধিকার।
এখন প্রশ্ন হলো কীভাবে পেমেন্ট গেটওয়ে তথ্য সুরক্ষিত রাখে? নিচে তা ব্যাখ্যা করা হলো।
অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ে কীভাবে তথ্য সুরক্ষিত রাখে?
অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ে বিভিন্ন পদ্ধতিতে তথ্য সুরক্ষিত রাখে। নিচে পদ্ধতিগুলো বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
- HTTPS প্রোটোকল: ট্রাঞ্জেকশন সিস্টেমটি একটি HTTPS (Hypertext Transfer Protocol Secure) ওয়েব ঠিকানায় ফরোয়ার্ড হয়। HTTPS হলো HTTP এর উন্নত ও নিরাপদ সংস্করণ।
- হ্যাশ ফাংশন: পেমেন্ট গেটওয়ে প্রতিবার ট্রাঞ্জেকশনের জন্য একটি সাইন্ড রিকোয়েস্ট নেয়। সাইন্ড রিকোয়েস্ট হলো একটি গোপন কীওয়ার্ড যা শুধুমাত্র পেমেন্ট গেটওয়ে এবং মার্চেন্ট জানে।
- আইপি ভেরিফিকেশন: পেমেন্ট পেইজের ফলাফল সুরক্ষিত রাখতে সার্ভার থেকে প্রেরিত রিকোয়েস্টের আইপি ঠিকানা যাচাই করা হয়, যাতে কোনো অবৈধ রিকোয়েস্ট শনাক্ত করা যায়।
- ভি.পি.এ (Virtual Payer Authentication): এটি পেমেন্ট গেটওয়েকে অতিরিক্ত নিরাপত্তা প্রদান করে ৩-ডি সিকিউর প্রোটোকলের মাধ্যমে, যা বিক্রেতা এবং ক্রেতা উভয়কে আলাদাভাবে যাচাই করতে সক্ষম হয়।
- ফ্রড স্ক্রিনিং টুলস: তথ্য হারানোর ঝুঁকি কমাতে পেমেন্ট গেটওয়েগুলো বিভিন্ন ফ্রড স্ক্রিনিং টুলস সরবরাহ করে। এর মধ্যে রয়েছে Card Code Value (CCV), Card Verification Value (CVV), Address Verification System (AVS) ইত্যাদি। এই টুলসগুলো প্রতারণামূলক ট্রাঞ্জেকশন প্রতিরোধে সহায়ক।
অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ের সুবিধাসমূহ কী কী?
অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ে গ্রাহক ও মার্চেন্টের মধ্যে একটি নিরাপদ মাধ্যমের সৃষ্টি করে। এটি ট্রাঞ্জেকশনে অংশগ্রহণকারী ব্যাংক এবং গ্রাহক উভয়কেই যাচাই করে।
অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এটি একসাথে লক্ষাধিক গ্রাহককে পেমেন্ট করার সুবিধা দেয়। এর মাধ্যমে যেকোনো অবস্থানে, যেকোনো সময়, যেকোনো স্থান থেকে সেবা বা পণ্য কেনা যায়।
অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ে আধুনিক ই-কমার্সের অন্যতম মূল উপাদান হিসেবে কাজ করে। এটি শুধু পেমেন্ট প্রক্রিয়াকে সহজ করে তোলে না, বরং গ্রাহক ও বিক্রেতা উভয়ের জন্য নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়।
HTTPS প্রোটোকল, হ্যাশ ফাংশন, আইপি ভেরিফিকেশন, VPA এবং ফ্রড স্ক্রিনিং টুলসের মাধ্যমে পেমেন্ট গেটওয়ে আমাদের ব্যক্তিগত ও আর্থিক তথ্যকে সুরক্ষিত রাখে। এ ধরনের সুরক্ষিত ব্যবস্থা থাকার ফলে আমরা নিশ্চিন্তে অনলাইনে কেনাকাটা করতে পারি।
সঠিকভাবে ব্যবহৃত হলে, পেমেন্ট গেটওয়ে আমাদের দৈনন্দিন লেনদেনকে নিরাপদ, দ্রুত ও নির্ভরযোগ্য করে তোলে, যা ডিজিটাল যুগে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডকে আরও সহজ ও কার্যকরী করে তোলে।
লেখাটি ভালো লেগে থাকলে আমাকে ফেসবুকে অনুসরণ করতে পারেন। এছাড়াও আমি টুইটারে এবং ইন্সটাগ্রামে সক্রিয় আছি।
মন্তব্য ( 4 )
বাংলাদেশে অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির কারণগুলি কী কী?
বেশ কিছু কারণ রয়েছে। অনলাইনে কেনাকাটার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি, মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের উন্নতি এবং ইন্টারনেট ব্যবহারের সহজলভ্যতা বাংলাদেশে অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির প্রধান কারণ।
অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ে ব্যবহারের সময় কোন ধরনের ঝুঁকি থাকতে পারে এবং সেগুলো কীভাবে এড়ানো যায়?
অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ে ব্যবহারের সময় হ্যাকিং, ফ্রড বা তথ্য চুরি হতে পারে। এগুলো এড়ানোর জন্য শক্তিশালী পাসওয়ার্ড ব্যবহার করা, HTTPS ওয়েবসাইট ব্যবহার করা এবং ব্যাংক বা মোবাইল ওয়ালেটের নিরাপত্তা ব্যবস্থা মানা উচিত বলে আমি মনে করি।